মোঃ সিদ্দিক মীরবহর।। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। গ্রামের শেষ ভাগে মুন্সীর বাড়ি। একেবাড়েই নদীর পাড়ে। চারকূলে এই ভিটিটুকু আর বাবা-মায়ের কবস্থান ছাড়া তার আর কিছু নেই। বাকি সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একসময় মুন্সীর পূর্ব পুরুষ ছিল এই গ্রামের সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবার। মুন্সীর বাড়ির আগেই মাতব্বরের বাড়ি। মাতব্বর তার বাড়ি থেকে হেটে মুন্সীর বাড়ির দিকে আসতে লাগলেন। মুন্সীর সাথে দেখা হওয়া মাত্রই মাতব্বর বললেন, আমার বাড়ির সামনে তোমার যে জায়গাটা আছে তা আমার বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য প্রয়োজন। মুন্সীর আজ অভাব অনাটনে সংসার চলছে। তার টাকার বড়ই প্রয়োজন। মাতব্বরের প্রস্তাব শুনেই মুন্সী খুশি হলেন। অন্তত কিছু টাকা হলে অভাবের সংসারে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে। কিন্তু মুন্সী তার শেষ সম্বলটুকু হারাতে চায় না। তবুও অভাব তাকে পিছু ছাড়ছে না। তাই সে মাতব্বরের কাছে জানতে চাইলো কত টাকা দিবে সে?
কথাটা শুনেই মাতব্বর চোখ বড় বড় করে বললেন, মাতব্বর কখনও টাকা দিয়ে জমি কিনে না। কথাটা মুন্সী শুনে মনে মনে ভাবলো মাতব্বরের সাথে বিষয়টি নিয়ে বিবাদে গেলে তার আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। একসময় মুন্সীর পৈত্রিক যে সম্পত্তি ছিল তা দিয়ে তার সংসার অনায়াসে চলে যেত। কিন্তু তার সেই পৈত্রিক ভিটে মাটি নদী গর্ভে বিলিন হওয়ায় আজ বড় অসহায় হয়ে পড়েছে মুন্সী। আজ আর সে তার সংসার চালাতে পারছে না। সামান্য চাল, ডাল, তেল কিংবা সবজি ক্রয় করা মুন্সীর জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এখন আর কেবল আছে তার ঐ একখন্ড জমি। যা তার পৈত্রিক ভিটে। আর একটু দূরে আছে তার মা-বাবা ঘুমিয়ে থাকা কবরস্থান। মুন্সী মাতব্বরের কথা শুনে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজ গৃহে ফিরল।
মুন্সীর স্ত্রী খুব রাগ করে আছে। মুন্সীর স্ত্রীর নাম নুরজাহান। খুব শখ করে নুরজাহান কে তার বাবা-মা মুন্সীর গৃহে পাঠায় সংসার করার জন্য। কিন্তু আজ মুন্সী গৃহে ফেরার সময় তার হাত দুটি একেবারেই খালি। স্ত্রী নুরজাহান তার এমন খালি হাতে ফেরাকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সে মুন্সীর দিকে তেড়ে গিয়ে বলতে লাগল, তুমি যদি দু’বেলা আহারের ব্যবস্থা না করতে পারো তবে যেখানে আমার দু’বেলা আহার জুটবে সেখানেই চলে যাব। ক্ষুধার জ্বালা আর নুরজাহান নিতে পারছেনা। কথাটা শুনেই মুন্সী খুব দুঃখ পেল। মুন্সী মনে মনে ভাবতে লাগল আজ বিবাহের দশ বছর পার হওয়ার পরে তার স্ত্রী নুরজাহান সংসারের সমস্ত মায়া মমতা ত্যাগ করে তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। স্ত্রী নুরজাহান কে এই মুহুর্তে ধরে রাখার মতো কোন সম্বলও মুন্সীর কাছে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই নুরজাহান কাঁদতে কাঁদতে তাকে ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এই মুহুর্তে মুন্সীর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, যার টাকা নেই তার কোন কিছুই নেই।
চিন্তায় দুঃখে মুন্সী শুয়ে আছে। ক্ষুধায় যেন তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো কেমন করছে। মুন্সী মনে মনে ভাবতে লাগল এভাবে না খেয়ে থাকলে তার সমস্ত শরীর একসময় দুর্বল হয়ে পড়বে। আর তখন সে আর উঠে দাড়াতে পারবে না। এমনকি প্রাণ নাশেরও সম্ভাবনা রয়েছে। মুন্সী ক্ষুধার্ত শরীরে কল্পনা করতে লাগল। সে কান পেতে শুনতে পেল তার শরীরের হার্ট, কিডনি, লিভার, পাকস্থলি সহ সবাই তাকে সতর্ক করছে। তারা সবাই মুন্সীকে জানাল যে, মুন্সী সামান্য ভুল করলে তারা আক্রান্ত হয়ে পড়বে। অতি দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করা দরকার। মুন্সী যদি তার ক্ষুধা দ্রুত নিবারণ না করে তবে তারা আক্রান্ত হয়ে মুন্সীকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলবে। কথাটা শুনে মুন্সীর চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে।
আর সে মনে মনে বলতে লাগল, হায়রে দুনিয়া গত আটাশটি বছর ধরে কোনদিন অনাহারে থাকিনি। প্রতিদিন খেয়ে খেয়ে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো কে আরাম আয়েছে রেখেছি। অথচ আজ তারাই আমার এই কঠিন দুঃসময়ে আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। কখন যে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটি শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখলাম ৪-৫ জন লোক কাছে এসে বলছে যা কিছু আছে সব দিয়ে দাও। মুন্সী অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো তোমরা কারা? তাদের মধ্যে একজন জানালো একদম চুপ, কথা বললেই মাথা থেকে দেহটা আলাদা করে ফেলবো। কথাটা শুনেই চুপসে গেল মুন্সী। চাইলেও আর বাঁধা দিতে পারছেনা সে। মুহুর্তেই তার ঘর থেকে সমস্ত কিছু নিয়ে চলে গেল ডাকাত দল।
বৈশাখে নদীতে পানি যেন ফুলে ফেপে উঠেছে। নদীর বড় বড় ঢেউ এসে মুন্সীর ভিটির উপর আছরে পড়ছে। মুন্সীর বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, নদী তার সীমানা বাড়ানোর জন্য তার শেষ সম্বল ভিটিটুকু নিয়ে যেতে চাইছে। মুন্সী অসহায়ের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। আর সে আক্ষেপ করে বলতে লাগল এতো বড় নদী, যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল পানি আর পানি, ঢেউ আর ঢেউ। কতবড় জায়গা নিয়ে এতবড় নদী। তারপরও আমার সামান্য শেষ সম্বল ভিটিটুকু নিয়ে যেতে চাইছে নদী। ‘হে আল্লাহ কে দিবে বাঁচার আলো? কে দিবে খাবার? যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল ব্যার্থতার অন্ধকার। মুন্সী আফসোস করে বললো, সবই যখন হারিয়েছি তখন বাকি জীবনটা বনে গিয়ে আল্লাহর ইবাদতে কাটাবো। কিন্তু কাজটা এত সহজ নয়। তারপরেও বনের দিকে মনের কষ্টে রওনা দিল মুন্সী।
বনে যেতেই শতশত মশা যেন ছুটে এসে বসে পড়লো মুন্সীর গায়ে। এখানে যে আর এক মিনিটও থাকার কোন উপায় নেই। তাই শুকনো ঘাসের উপর দিয়ে হাটতে লাগল মুন্সী। চোখে মুখে কেবল হতাশার ছাপ। হঠাৎ মুন্সীর দৃষ্টি গেল দূরে। মুন্সী দেখতে পেল একটি ক্ষুধার্ত বাঘ তার দিকে ছুটে আসছে। মুন্সী বললো, হায় এখন কি উপায়? মুন্সী বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য নদীতে ঝাপ দেওয়ার চিন্তা করলো। কিন্তু নদীর তীরে যেতেই মুন্সী দেখতে পেল বিরাট এক কুমির সেখানে ওত পেতে আছে। যেন কুমিরটি কতদিনের ক্ষুধা নিয়ে হাঁ করে আছে। হায়রে অদৃষ্ট। মুন্সী উপায় না পেয়ে একটি গাছের কাছে গেল বাঁচার জন্য। ভেবেছিলো গাছটি বেয়ে উপরে উঠে যাবে সে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পেল একটি বিষাক্ত সাপ ফনা তুলে আছে তাকে ছোবল দেওয়ার জন্য।
মুন্সী কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। মুন্সী বাঁচার জন্য বাতাসের বেগে জোরে দৌড় দিল। কত পথ দৌড়ে পারি দিল তা বলতে পারছেনা মুন্সী। বিপদ যখন আসে তখন এভাবেই চারদিক থেকে আসে। মুন্সী হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো এবং আল্লাহকে অভিমান করে বলতে লাগলো, হে আল্লাহ মানুষের সুখ-শান্তির জন্য এই ধরণীকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন তবে বাঘ, কুমির, সাপ দুনিয়ায় পাঠালেন কেন? মুন্সী মনকে শান্তনা দিয়ে বুঝালো আল্লাহ মহন এবং উত্তম পরিকল্পনাকারী। মুন্সী অনেক অভিমান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিল সে আর গ্রামে থাকবে না। যেখানে বাঘ, কুমির, শাপ থাকবে না সেখানে চলে যাবে সে। তাই সে ঘরের খাঁচাটা তিনশত টাকায় বিক্রি করে শহরের পথে পাড়ি জমালো। অন্তত এই সামন্য অর্থ দিয়ে শহরে ফেরী করে কোন মতে বাঁচা যাবে হয়তো।
মুন্সী শহরের সীমানায় পা রাখতেই দু’টি ছেলে তার দিকে পিস্তল তাক করে বলে উঠলো তোর কাছে যা আছে সব দিয়ে দে। না হয় এই পিস্তল দিয়ে গুলি করে তোর খুলি উড়িয়ে দিব। মুন্সী বলে উঠলো এই সামান্য তিনশত টাকাও তোমরা নিয়ে গেলে। শহরে পৌছে মুন্সী সারাদিন দোকানে দোকানে গিয়ে কাজের সন্ধান করলো। কিন্তু কেউই তাকে বিশ্বাস করতে পারলো না। কারণ এর আগে অনেকেই কাজের নাম করে টাকা পয়সা নিয়ে কেটে পড়েছে। কেউ তাকে চেনে না। ক্ষুধায় মুন্সীর পেট চো চো করছে। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে লাল রং ছড়াচ্ছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে ধরণীতে। মুন্সী প্রকৃতির এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় যাবে সে, কার কাছে থাকবে আর কিইবা খাবে? একটু কাছে যেতেই দেখতে পেল বেশ কারুকার্য করা একটি আলিশান বাড়ি।
মুহুর্তেই মুন্সী এই আলিশান রাজপ্রসাদ দেখে ভাবতে লাগলো এখানের মানুষগুলো কত সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ আর বিলাসী জীবন পার করছে। যাই যদি সামান্য খাবার পাই। ব্যার্থ জীবনের পুঞ্জিভূত আশা নিয়ে ক্ষুধাটুকু মিটানোর আশায় সে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়াল। কিন্তু বাড়ির দারওয়ান মুন্সীকে সেখানে দাড়াতে দিল না। দারওয়ান মুন্সীকে জানালো বিরক্ত করলে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিবে সে। মুন্সী এবার মনের দুঃখে ভাবতে লাগলো একেই বলে শহর। যেখানে নেই কোন মায়া-মমতার চিহ্ন। আছে কেবল মানুষের ভোগ বিলাসিতা। ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে মুন্সী রাস্তার একপাশ দিয়ে হাটছে। রাত গভীর হতেই মানুষের যাতায়াত কমে যাচ্ছে। সবাই আপন আপন নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু মুন্সী দুঃখের সাথে জানতে চাইলো তার যাওয়ার জায়গা কোথায়?
মুন্সী দেখতে পেল রাতের আধারে শহরে টহল পুলিশ নেমে গেছে। তাকে একা পেয়ে হাজারো প্রশ্ন আরম্ভ করলো পুলিশ। জানালো থানায় নিয়ে যাবে তাকে। অনেক কাকুতি মিনতির পর মুন্সীকে ছেড়ে দিল তারা। যে আশা নিয়ে মুন্সী গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছিলো সে আশা ভেঙ্গেচুড়ে চূড়মার হয়ে গেছে তার। মুন্সী উপলব্ধি করতে পারলো এ পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই কিছু নেই। সে বড় অসহায়। এর চেয়ে বাবা-মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মুন্সী। কষ্টে-দুঃখে আর অভিমানে মুন্সী শহর ছেড়ে আবার গ্রামের পথে রওনা দিল। ইট পাথরের এই শহরে মুন্সী বড়ই বেমানান। শহরের মানুষগুলো বড়ই স্বার্থপর। মুন্সী ভেবেছিলো শহরে হয়তো তার কোন একটি জায়গায় ঠাই মিলবে। অন্তত দু’বেলা খেয়ে বাঁচতে পারবে। কিন্তু তার এ ধারণা ছিলো ভুল।
গ্রামে এসে বাবা-মায়ের কবরের পাশে গিয়ে থাকবে সে। তার জীবনের শেষ সময়টুকু সে সেখানেই কাটাতে চায়। ওখানে গিয়ে মরে, পঁচে, গলে মাটির সাথে মিশে যেতে চায় সে। কিন্তু কবরের কাছে যেতেই মুন্সী শুনতে পেল কবরে আসতে হলে অবশ্যই নেক আমল নিয়ে আসতে হবে। আর তা না হলে কবরের কঠিন আাযাব ভোগ করতে হবে তাকে। মুন্সী বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। এবার মুন্সী ভাবতে লাগলো পৃথিবীর বুকে কি একটু জায়গা নেই যেখানে সে একটু শান্তিতে বাস করতে পারে? কোথায় যাবে সে? কোথায় তার শেষ ঠিকানা? কিছুই জানা নেই তার। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাতেই মুন্সী দেখতে পেল, কি সুন্দর তাঁরাগুলো ঝলমল করে জ্বলছে। কত যেন সুখ, কত যেন শান্তি, কত যেন আনন্দ ঐ দূর আকাশের পানে। এই মাটির পৃথিবী ছেড়ে ঐ দূর আকাশে তাঁরাদের মাঝে যদি হারিয়ে যেতে পারতো সে তাহলে হয়তো অনেকটা শান্তি খুজে পেত।
মুন্সী তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করে অতি দুঃখের সাথে প্রতিপালক কে জানালো, দুনিয়ায় আর মানুষ পাঠাইয়েন না আল্লাহ। যদি মানুষ পাঠান তবে সৎ ও চরিত্রবান মানুষ পাঠাইয়েন। মৃত্যুর পর অদৃষ্টে কি আছে তা জানি না। মানুষের শান্তির জন্য এই ধরণী কত ফুল-ফল, নদী-নালা, গাছপালা দিয়ে সাজিয়েছেন আপনি। অথচ কপালে আজ দু’বেলা আহার জুটছেনা আমার, নেই একটু থাকার জায়গা, নেই একটু শান্তি। যদি মানুষকে দুনিয়ায় পাঠাতেই হয় তবে যেন দু’বেলা আহার দিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে পাঠিয়েন। যেখানে থাকবেনা আর কোন অত্যাচার, অবিচার, উচু-নিচু ভেদাভেদ আর ক্ষুধার এমন জ্বালা। থাকবে শুধু মানুষে মানুষে ভালোবাসা।
মোঃ সিদ্দিক মীরবহর
নলছিটি, ঝালকাঠি, বাংলাদেশ।