Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

Headline

Notice: To read this website in your country's language, please change the language. Contact us for advertising: +8801516332727 (What's App) Thank you.

আমার ছোটবেলা


মোঃ রিসালাত মীরবহর।। আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই মাতৃগর্ভের জন্ম নিয়েছে অসংখ্য প্রকৃতি প্রেমী। যারা আজ অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক হয়ে নাম লিখিয়েছেন হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যে। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে হয়েছেন সাহিত্য প্রেমী। যেমন: পল্লী বাংলার চিত্র মনে হয় অসমাপ্ত হয়ে থাকেবে পল্লী কবি জসিম উদ্দীনকে ছাড়া। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অনেক উচ্চে আসীন হয়ে আছে। এছাড়া জীবনানন্দ দাসের সেই বিখ্যাত কবিতা “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়”। যা জানান দেয় আবহমান বাংলার নদীগুলো যেমন বয়ে চলছে তেমনি বাংলা সাহিত্যও যুগে যুগে বয়ে চলছে অনন্য সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের হাত ধরে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহম্মদ, সুফিয়া কামাল, সুকুমার রায়, শাসসুর রহমান, মাইকেল মধুসূদন দত্ত সহ অগনিত সব কবিরা মিলেমিশে আছে বাংলা সাহিত্যের গভীর থেকে গভীরে। হাজার বছরের সেই পল্লী সাহিত্য রয়ে গেছে অগণিত কবি আর লেখকের মাঝে। তাদের হাত ধরেই সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলা সাহিত্য। তাদের বিখ্যাত সব লেখনীর দ্বারা আমরা স্বাদ পাই হাজার বছরের আবহমান বাংলার সেই পুরানো ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি সম্পর্কে।

ঠিক তেমনি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর তীরে প্রকৃতির এক অপরূপ মনমুগ্ধকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা আমার ছোটবেলা। সুগন্ধা নদীতে বয়ে চলা স্রোতের খুব কাছাকাছি আমার আপন ঠিকানা। আমার চিরচেনা সেই আপন নীড়। যেখানে জীবনের অনেকটা সময় পার করেছি। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে বুঝতে শিখেছি। বয়ে চলা নদীর সেই স্রোতের শব্দ যেন আজও আমার কানে বাজে। এখানেই কাটিয়েছি জীবনের সবচেয়ে মধুময় জীবন। নানা পাখির কলতানে মুখরিত ছিল ঘুম ভাঙ্গা সেই স্নিগ্ধ সকাল। দোয়েল, শালিক, শ্যামা, টিয়া, চঁড়ুই সহ নানা পাখির ডাকগুলো যেন আজও শুনতে পাই। ঘুম ভেঙ্গে যখন ছোট ছোট পায়ে ওদের কাছাকাছি যেতাম তখনই উড়াল দিয়ে চলে যেত গাছের উচুঁ ডালে। আর তখন খিলখিলিয়ে হাসতাম। কতনা সুখ লুকিয়ে ছিল সেই হাসির মাঝে। যা আজ বলতে গেলে একেবারেই অধরা।

গ্রীষ্মের রোদ যেন কিছুই মনে হতো না তখনকার দিনে অবিরাম ছুটে চলার কাছে। চারদিকে কেবল মুহুমুহু আমের ঘ্রাণ। নিচ থেকে ঢিল মারলেও পড়তো না উচুঁ ডালে থাকা সুস্বাদু সেই আম। যদিও বা কখনও পড়তো সেটা নিয়ে কতইনা হইচই ছিল তখনকার সময়ে। এরপর লকট, লিচু, জাম, আমড়া, বড়ই সহ নানা রকমের ফল কুড়াতে যেন প্রতিযোগীতা লেগে যেত সবার মাঝে। সে কি আনন্দ আর হাসি মাখা মধুর স্মৃতি।

গ্রীষ্ম পেরিয়ে যখন বর্ষা আসতো তখন খাল-বিল, নদী-নালা থাকত পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ফজরের আযান হলে অসমাপ্ত ঘুম রেখে কখনও উঠে পড়তাম তাল কুড়াতে। গিয়ে দেখতাম পানিতে ভেসে আছে অসংখ্য তাল। সেই পাঁকা তাল নিয়ে আসতাম ঘরে। তা দিয়ে মা তৈরি করে দিত সুস্বাদু পিঠে। বর্ষার আগমনে কখনো কখনও আমাদের নদীর পানি ফুলে ফেপে উঠতো। এমনকি আমাদের বাড়ির উঠোনে নদীর সেই পানি বয়ে যেত হাটু সমান। তাকিয়ে দেখতাম সেই পানিতে বিচরণ করছে নানা রঙের সাপ, পোকা-মাকর আর ছোট ছোট মাছ। রাত যত গভীর হতো চিন্তা তত বাড়ত। গ্রামে তখনকার সময় ডাকাত পড়ার ভয় থাকত। চারদিকে কেবল পানি আর পানি। নির্জন নিস্তব্ধ কোথাও যেন কোন আলো নেই, এমন সময় কখনও কখনও ডাকাত পড়ার খবরে জেগে ওঠতো গোটা গ্রাম। অনেকটা নির্ঘুম রাত পার করতে হতো সবার।

সেই ছোট বেলায় নদীর পাড়ে গিয়ে খেজুর পাতা ছিড়ে সেটা দিয়ে চরকি বানিয়ে বাতাসে ঘুরাতাম। কত কাটার ফোর খেয়েছি। তাও চরকি বানানো বন্ধ করতাম না। গাছের সাথে বেধে আসতাম সেই চরকি। যাতে চরকি অনরবরত ঘুরতেই থাকে। কিন্তু পড়ে গিয়ে দেখতাম চরকি আর নেই। নদীর পানিতে ভেসে গেছে শখের সেই চরকি। বিকেল হলে ছোট ছোট ভাই-বোন মিলে ছিবুড়ি, গোল্লাছুট খেলতাম আমরা। কখনো কখনো বেধে যেত ঝগড়া। রাগে আর অভিমানে ভেঙ্গে যেত খেলার সেই সুন্দর আয়োজন। তখনকার সময় রেডিও ছাড়া আর কোন প্রযুক্তি ছিলনা। সন্ধ্যার পরে দাদা তার পাঞ্জেগানা মসজিদে বসে তার রেডিও টিউন করত। অধীর আগ্রহ আর উৎসুক হয়ে শুনতাম তা। কি আশ্চার্য! মানুষের দেখা নেই অথচ ছোট একটি বক্সের মধ্যে ভেসে আসতো কথা, গান, কবিতা সহ নানা রকম অনুষ্ঠানমালা। অবাক হয়ে শুনতাম সেসব। আর হাত তালি দিয়ে হাসতাম।

শীতের আগমনে সকালে নতুন ধানের পিঠে বিশেষ করে চিতই পিঠে আর খেজুর রস সাথে নারকেল। আহ! কি স্বাদ সেই সময়ে। ঘন কুয়াশাঘেরা চারদিকটা কতইনা ভালো লাগত। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাটা ছিল অনেক আনন্দের। সেই সময় চাদর জড়িয়ে কিছু খরকুটো এনে তাতে আগুন দিয়ে হাত-পা গরম রাখতাম। সকাল হলেই ঘন কুয়াশার মধ্যে কেউ কেউ খেজুর রস নিয়ে আসতো আমাদের গাছ থেকে। উঠোনে হাড়িগুলো সাজিয়ে রাখা হতো। আমার দাদী মানুষ নিয়ে সেই হাড়িতে থাকা রস গরম চুলোয় ঢেলে দিত। অনেকটা পর সূর্য মামা উকি দিত আকাশের বুকে। সকাল থেকে সেই রসে তাপ দেয়া হতো। বিকেল হলে সেই রস ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হতো। একটা সময় আসত যখন নবান্নের উৎসবে মেতে উঠতো গোটা গ্রাম। মেলায় আসতো নানা শ্রেণী পেশার অসংখ্য মানুষ। বসতো নানা খাবারের পসরা নিয়ে দোকানিরা। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতাম সেই মেলায়। নানা রকম মিষ্টান্ন কিনতাম। নানা ধরনের বাশি আর বেলুনে মুখোরিত থাকত মেলা। এভাবে একটি আনন্দমুখর দিন পার হতো আমাদের।

কখনও কখনও বিকেল হলে বের হতাম পাখি শিকারে। চারদিকে কেবল ধানের ক্ষেত দুলছে বাতাসে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি পেড়িয়ে যেতাম অনেকটা পথ। সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম দাদা মাগরিবের আযান দিচ্ছেন। এখনও দাদার সেই সুমধুর আযানের ধ্বনি আমার কানে বাজে। বিদ্যুৎ ছিলনা তখন। হেরিকেন আর কুপির আলো দিয়ে ঘর আলোকিত করা হতো। পড়তে বসলে মা শুকনো মুড়ি আর আখের গুড় দিয়ে যেত। তখনকার সময় মুড়ি আর খৈ ছিল মজার খাবার। রাতে জানালা দিয়ে যখন বাইরে তাকাতাম দেখতাম ঝোপের মধ্যে অসংখ্য জোনাকি পোকার মেলা। কি অপরূপ তালে জ্বলছে আর নিভছে সেই জোনাকি পোকাগুলো। নদীতে দেখতাম রূপালী চঁদের আলোয় পাল তুলেছে নৌকার মাঝিরা। মনের সুখে পল্লীগীতি আর ভাটিয়ালী গান গাইতো তারা। ঝলমলে সেই রূপালী চাঁদের আলোয় এমন দৃশ্য দেখতে চলে যেতাম নদীর কাছে। হু হু করে বাতাস বইছে। রূপালী চাঁদের আলোয় নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে অগনিত নৌকা। তখন জানতাম না এসব নৌকার গন্তব্য কোথায়। কেউ কেউ বলে উঠতো ও মাঝি ভাই আরেকটা গান ধরো না। মাঝি তার আপন মনে গান ধরত। গান শেষ হতো অনেকটা দূরে গিয়ে যখন আর নৌকো দেখা যেত না।

বসন্তের বাসন্তি রঙে সাজতো গোটা গ্রাম। গাছে গাছে নতুন রঙ বেরঙের পাতা। নতুন ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা পাখ-পাখালি সহ নানা রঙের ঘাস ফড়িং আর প্রজাপ্রতিরা। এ যেন প্রকৃতির এক অনন্য রূপবৈচিত্র। গ্রামের সেই প্রতিটি সন্ধ্যা আমার কাছে আজও সোনালী দিনের মতো মনে হয়। প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা আর হারানো সেই ছোটবেলা সবকিছুই আজ আমার অতীত। প্রকৃতির প্রেমে না পড়লে আমরা কখনও এগুলো উপভোগ করতে পারবো না। চাইলেই ফিরে যেতে পারবো না অতীতের সেই সোনালী দিনগুলোতে।

এখন আর সেই দিনগুলো খুজে পাইনা। শুনতে পাইনা মাঝির সেই দরদী গলায় পল্লীগীতি কিংবা ভাটিয়ালি গান। রূপালী চাঁদের আলো এখন আর আমার মন কাড়ে না। জোনাকি পোকগুলোও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। খেজুর রসে আগের মতো আর সেই স্বাদ নেই। সকালের সেই পাখিগুলোর কলতানি এখন আর আমার ঘুম ভাঙ্গায় না। দাদার সেই দরদ মাখা আযানের ধ্বনি এখন আর শুনতে পাইনা। নদীতে এখন আর সেই পাল তোলা নৌকো নেই, নেই সেই অচেনা মাঝি। প্রযুক্তির দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে সেই আনন্দময় জীবন ধারা। এখন কেবলই সবকিছু স্মৃতি হয়ে আছে আমার সেই ছোটবেলা। তবুও সেসব পুরনো দিনের কথা মনে করতেই আনন্দিত হই। মনে হয় ছুটে যাই সেসব দিনগুলোতে। শহরের এই চার দেয়ালের মাঝে প্রযুক্তির এই ছোয়ায় প্রকৃতি আজ বড় অদৃশ্যমান মনে হয়। মনে হয় আমি হারিয়ে ফেলছি জীবনের অনেকটা আনন্দ অনেকটা সুখ। হারিয়ে ফেলেছি আমার সেই ছোটবেলা।

Writer & Editor। Obalardak
E-mail: obalardak@gmail.com
Barishal Sadar, Barishal, Bangladesh
Mobile: +88 01516332727 (What's App)