মোঃ রিসালাত মীরবহর।। খুজতে খুজতে একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। চাচাতো ভাই বিজ্ঞাপনে দেওয়া ঠিকানায় যেতে বললো। আমি গেলাম সেখানে। গিয়ে ইন্টারভিউ দিলাম। ইন্টারভিউতে নাম, ঠিকানা ও কি করছি সে বিষয়ে জানতে চাইলো। সব ঠিকঠাক ভাবে উত্তর দিলাম। ইন্টারভিউ শেষে জানালো আপনার চাকুরি হয়ে গেছে। আগামী ১ তারিখ থেকে জয়েন করেন। আমি তো খুব খুশি। আমি তখন সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা একটি তরুন। চাকরির বিষয়ে তেমন কিছু জানলাম না। কথা মতো ১ তারিখে জয়েন করলাম। এটি একটি পোশাকের শো রুম। ঢাকা ধানমন্ডির কাছাকাছি। বেতন ৪২০০ টাকা। সকাল ৮:৩০ টা থেকে রাত ১১:০০ টা পর্যন্ত। এটি আমার দ্বিতীয় চাকুরি। পোষাক বিক্রেতা হিসেবে চাকুরি নিলাম। চাকুরি হওয়ার পর চাচাতো ভাইয়ের বাসা থেকে চলে আসলাম। কাছাকাছি জায়গায় মামার বাসা। সেখানে উঠলাম। প্রতিদিন দুপুরে বাইরে খেতে হয়। তখন ২০০৮ সাল ছিল। দুপুরে সামান্য ভর্তা আর ভাত খেতাম। একেক দিন একেক ভর্তা। ভাত ১০ টাকার আর ভর্তা ৫ টাকার। আর ফ্রি পাতলা মসুর ডাল। সবমিলে বিল আসত মাত্র ১৫ টাকা। এভাবেই দিন কাটতে লাগল।
কিন্তু ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না করার কারণে বেশে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে মামা হঠাৎ জানিয়ে দিল মেসে উঠতে। ১২ ঘন্টার বেশি ডিউটি। অথচ বেতন মাত্র ৪২০০ টাকা। ৪টি শুক্রবার বাদে আমার প্রতিদিন বেতন দাড়ায় ১৬১.৫৩ টাকায়। যা দিয়ে ২০০৮ সালে ঢাকায় চলা ছিল আমার জন্য বেশ কঠিন। আমার চা-পান কিংবা বিড়ি-সিগারেটের কোন নেশা ছিল না। এটা কখনও ছিল না। কিন্তু মাঝে মধ্যে নাস্তা করার পয়সাও থাকতো না। প্রতিদিন গাড়ি ভাড়া যেত ৪০ টাকা করে। ৬ মাস চাকুরি কারর পর ছেড়ে দেই। চাকুরি ছাড়ার পর মন খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে চলে আসি। এরপর আবার চাকুরির চিন্তা। এবার গ্রামের বাড়ির এক পরিচিত কাকার সাথে চাকুরির আলাপ করলাম। তিনি জানালেন তার ভাইপোর ঢাকাতে দোকান আছে। সেখানে একজন লোক দরকার। আমি রাজি হয়ে গেলাম। বরিশাল থেকে ঢাকা গেলাম। বাড্ডা লিংক রোডের মুখে মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকান। প্রতিদিন সকাল ৭:০০ টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হয়। দোকান বন্ধ হয় রাত ১২:০০ টায়। আমি যখন খাবার খেতাম তখন রাত বাজতো ১:০০ টা অথবা ১:৩০। বিছানায় যেতাম রাত কখনও কখনও ২:০০ টায়। এভাবে ২৬ দিন পাড় করি। কোন বেতন পেলাম না। কারণ কথা ছিল পেটে ভাতে খাটবো।
মনে মনে ভাবলাম এভাবে আর চলতে পারে না। সেখানে বলে চলে আসলাম। বাড়ি ফিরবো ঠিক করলাম। কিন্তু গাড়ি ভাড়াটাও পাইনি। অন্যের কাছ থেকে ধার করে গাড়ি ভাড়া দিলাম। হঠাৎ আমার গ্রামের বাড়ির এক বড় ভাইয়ের ফোন আসলো আমার ফোনে। জানতে চাইলো চাকুরি করবো কিনা? আমি সম্মতি দিলাম করবো। দ্রুত উনি দেখা করতে বললেন ওনার অফিসে। অফিসে আসলাম দেখলাম অসংখ্য মানুষ। কোর্ট আর টাই পড়া। দেখলাম ৩-৪ জন মিলে কি সব আলোচনা করছে। এভাবে সময় পেরিয়ে যায় আলোচনা থামে না। শুধু আলোচনার মানুষগুলো পরিবর্তন হয়। ঘুরেফিরে ঐ একই আলোচনা। অফিস বেশ আলিশান। সবকিছু পরিপাটি। সকাল ৯:০০ টায় আসতাম আর রাত ৯:০০ টায় যেতাম। কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রির কাজ করতাম। টাকা দিয়ে লোক ভর্তি হতো আর তাদের তথ্যগুলো অনলাইনে এন্ট্রি দিতাম। কিন্তু সমস্যা হলো আমার হাতে কোন টাকা নেই যে দুপুরে খাবো। যিনি আমাকে চাকুরিতে আনলেন তিনি যদি মনে করতেন খাওয়াবেন তাহলে খেতাম। অন্যথায় না খেয়ে থাকতাম।
২১ দিন এভাবে কেটে গেল। ঠিক করলাম এভাবে আর চলতে পারে না। না খেয়ে থাকাটা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের মধ্যে একটি। ২১ দিনের মাথায় আমার এক মামা কল দিলেন আমার ফোনে। তিনি জানালেন একটি সরকারি অফিসে কম্পিউটারে কাজ করতে হবে। আমি দ্রুত সম্মতি দিলাম। তিনি আমাকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সেই অফিসে দেখা করতে বললেন। আমি সময় মতো দেখা করতে গেলাম। ওনারা আমার সব কাগজ পত্র দেখে আমাকে জানালো আগামী ৭ দিন যদি আমার কাজ দেখে পছন্দ হয় তবে আমাকে চাকুরিতে রাখবেন। অন্যথায় আমাকে বাদ দিয়ে দিবেন। আমি এই সাত দিন কম্পিউটারে কাজ করতে লাগলাম। কম্পিউটার চালাতে খুব বেশি পারতাম না। টাপিং স্প্রিডও বেশি ছিল না। সেখানে গিয়ে কম্পিউটারে টানা সাত দিন ধরে সাধনা করলাম। আমাকে যে রুমে দেওয়া হলো সেখানে সবাই বিসিএস ক্যাডার। শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় বলা চলে।
সাত দিন পার হওয়ার পর অফিস থেকে জানানো হলো চাকুরি হয়েছে। তবে অস্থায়ী। একটি প্রকল্পের অধিনে। বেতন ৭০০০ টাকা। আউটসোর্সিং চাকুরি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে অফিসের সব কাজ শিখে নিলাম। আমাকে দুজন ম্যাডাম সহযোগীতা করেছেন। ওনারা বিসিএস ক্যাডার। একজন সিনিয়র এসিসট্যান্ট চিফ অন্যজন এসিসট্যান্ট চিফ। দুজনার আচার আচরণ খুবই ভালো। কোন কিছু না বুঝলে ওনারা শিখিয়ে নিতেন। এভাবে প্রায় ২০১০ সাল থেকে চাকরি করছি এখানে। বেতন এর মধ্যে একটি টাকাও বাড়েনি। এর মধ্যে অন্য অফিস থেকে আসা একজন অফিসার আমাকে খুশি হয়ে ১,০০০ টাকা দিলেন। আমি চাইনি। কিন্তু বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। কারণ আমি কোন কাজ করলাম না কিন্তু উনি আমাকে ১,০০০ টাকা দিয়ে দিলেন। তখন বেতনের পর ১,০০০ টাকা আমার কাছে অনেক কিছু মনে হতো। মেস ভাড়া, খাওয়া, বুয়া বিল ও নিজের পকেট খরচ সহ তখন ৭,০০০ টাকায় হতো না।
এই ১,০০০ টাকা পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আমার জ্বর হলো। জ্বর কিছুতেই থামছে না। ফার্মেসি থেকে ওষুধ খেলাম। তারপরও জ্বর কমেনা। এরপর গেলাম সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে এসে খেলাম। কিন্তু জ্বর কমেনা। সহ্য করতে না পেরে বাড়িতে চলে আসলাম। এসে কয়েকদিনের মাথায় জ্বর সেরে গেলে সুস্থ হয়ে আবার ঢাকায় গেলাম। এর কিছুদিন পর আরেকজন অফিসার এসে আমাকে ২,০০০ টাকা দিলেন। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওনারা কেন আমাকে টাকা দিচ্ছেন। বিষয়টি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগলো না। এই টাকা পাওয়ার পর খরচ হয়ে গেলে আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এবার মাথায় সিস্ট হলো। সে কি যন্ত্রণা। টানা সাতদিন অসুস্থ। এরপর হাসপাতালে গিয়ে ওষুধ খেয়ে তারপর সুস্থ হলাম। পরপর দু’বার টাকা পাওয়ার পর এভাবে অসুস্থ হওয়ার পর চাকুরি থেকে মন উঠে গেল। অন্যদিকে আমার স্যার অফিসে না থাকতে প্রায়ই খাম আসতো। খামগুলো কখনো হলুদ কখনো খাকি রং এর। মানে চিঠির খাম। কিন্তু চিঠির খাম কি এতো মোটা হয়? কি জানি, জানি না। হয়তো অফিসের কোন কাজের। স্যারের টেবিলে রেখে দিতাম। ও হ্যাঁ যে স্যারের সাথে ডিউটি করি তার নাম বাজলুর রহমান (ছন্মনাম)
হঠাৎ একদিন বজলুর রহমান (ছন্মনাম) স্যারের সামনে থাকা একজন লোক আমাকে ডেকে বললেন সিগারেট এনে দিতে। কিন্তু আমি অপরাগতা প্রকাশ করলাম। তখন তিনি পকেট থেকে ৫০০ টাকা উঠিয়ে আমার হাতে দিলেন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না তিনি আমাকে টাকা দিয়ে কিনতে চাইছেন। যার সাথে আমার অফিসারও জড়িত সম্ভবত। আমি কখনও ধুমপান করিনি। আর কাউকে ধুমপানে সহযোগীতাও করতে ইচ্ছুক নই। এই বিষয়টি চিন্তা করে টাকাটা হাতে নিয়ে আমি পিওনের কাছে গিয়ে টাকাটা দিয়ে বললাম স্যার সিগারেট নিতে বলেছেন। বলেই আমি চলে আসলাম। পিওন সিগারেট নিয়ে বজলুর রহমান (ছন্মনাম) স্যারের কাছে গেল। বিষয়টি স্যার সহজে মেনে নিতে পারবেন কিনা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর মধ্যেই ঈদ এসে গেল। আমার বেতন যার মাধ্যমে হয় সেই স্যারের নাম সফিউল্লাহ বাদল (ছদ্মনাম)। তিনি হেড অফিসে কর্মরত আছেন। হঠাৎ স্যার আমাকে কল দিলেন। জানালেন আমার বেতন পেয়েছি কিনা? আমি বললাম না পাইনি স্যার। তারপর বললেন, আপনার ডিউটি অফিসার আমার কাছে আপনার বেতনের টাকা চেয়েছেন। আমি বললাম স্যার তিনি কেন বেতনের টাকা আপনার কাছে চাইবেন? স্যার বললো আজ বিকেলে অফিস শেষে এসেই দ্রুত আপনার বেতনের টাকা নিয়ে যাবেন। বিষয়টি নিয়ে আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। আমার বেতন কেন আমার ডিউটি অফিসার হেড অফিসের স্যার সফিউল্লাহ বাদল (ছদ্মনাম) স্যারের কাছে চাইবেন?
পরবর্তী লেখা পড়তে চোখ রাখুন (৩য় পর্বে) .................
Mobile: +88 01516332727 (What's App)