Hot Widget


Type Here to Get Search Results !

যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার, সেখানেও চলছে নানা সমস্যা


মোঃ রিসালাত মীরবহর।। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবেই মানুষের মূল পরিচয়। বহুকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ভাবে পরিবার তৈরি করে আসছে। খুজে নিয়েছে সুখ-শান্তি, হাসি-কান্না, আনন্দ-উপহাস। মানুষ পরিবারকে ভালোবাসে। কারণ পরিবারের মধ্যেই সে সবকিছু খুজে পায়। একটি মানুষ পরিবারের মাধ্যমেই জানতে পারে তার আসল পরিচয়। সবাই চায় পরিবারের মোহ-মায়া আর বন্ধনে অটুট থাকতে। প্রাচীনকাল থেকে পরিচালিত পরিবারগুলো যেখানে সবাই একসাথে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে, সেখানে আধুনিক যুগে তা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানিরা ও পরিবারবিদরাও বিভিন্ন ভাবে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পরিবারে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইনস্টন চার্চিল মন্তব্য করে বলেছেন, কোন সন্দেহ নেই যে পরিবার ও আপন ঘরের মাঝেই সমস্ত গুণাবলী, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ গুলোর বিকাশ হয়, শক্তিশালী হয় এবং টিকে থাকে। পরিবার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করতে গিয়ে জিম কসাই বলেন, এমন কিছু নেই যা আপনাকে পরিবারের চেয়ে আপন করে তোলে। পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেক বিশ্লেষক জে. কে. রাউলিং বলেন, পরিবার হলো জীবনের ঝড়ো সমুদ্রের মাঝে একটি লাইফজ্যাকেট।

অন্যভাবে বলতে গেলেপরিবার হচ্ছে গাছের ডালের মতো। আমরা বিভিন্ন দিকে বেড়ে উঠিতবুও আমাদের শিকড় এক যায়গাতেই থেকে যায়। পরিবার একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে মায়া-মমতাআনন্দ-বেদনাসুখ-দুঃখ সহ জীবনের সকল বিষয় কিংবা অনুভূতিগুলোকে সবার সাথে ভাগ করে নেয়া যায়।আমাদের দেশে পূর্বের গ্রামীণ জনপদের পরিবারগুলো ছিল মূলত যৌথ পরিবার। যেখানে মা-বাবাভাই-বোননানা-নানীদাদা-দাদু সবাই একসাথে মিলেমিশে বসবাস করতো। পরিবারের সবাই ছিলো যৌথ পরিবারের অংশীদার। সবাই মিলেমিশে সকল কাজে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করতো। কোন ভেদাভেদ ছিলো না। সবাই সবার সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে বসবাস করতো।

তবে দিন বদলেছে। মানুষ শিক্ষাগত দিক থেকে উন্নতি সাধন করেছে। অর্থনৈতিক ভাবে অনেকেই সাবলম্ভী হতে পেরেছে। প্রযুক্তির ছোয়া ও কল-কারখানার উন্নতি সাধনের পাশাপাশি মানুষের জীবন মানের উন্নতি ঘটেছে। ফলে মানুষের চিন্তাধারায়ও ব্যপক পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ আশেপাশের সকল মানুষের কথা ভাবতো। সব মানুষের উপকারের কথা চিন্তা করতো। বিপদে আপদে পাশে দাড়াত। কিন্তু মানুষের চাহিদায় এককেন্দ্রীক চিন্তার ফলে মানুষ সে অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এরপর মানুষ নিজের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ভাবতে শুরু করে। কিন্তু নানা জটিলতা আর সমীকরণে সে চিন্তা থেকেও মানুষ সরে দাড়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে। 

পরবর্তিতে মানুষ নিজ পরিবার নিয়ে ভাবতে শুরু করে (নিজ পরিবার বলতে এখানে মা-বাবা ভাই- বোনকে নিয়ে পরিচালিত পরিবারকে  বোঝানো হয়েছে)। কিন্তু সেখানেও বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি বিপত্তি ঘটে নানা পারিবারিক সমস্যায়। যা পারিবারিক অশান্তি তৈরি করে। বিশেষ করে উদাহরণস্বরূপ- বাবার সাথে মায়ের দ্বন্দ, মায়ের সাথে ছেলের দ্বন্দ অথবা বউয়ের সাথে শাশুড়ীর দ্বন্দ, ভাই-বোনদের মধ্যে পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ কিংবা মনোমালিন্যতা অথবা কথা বা কাজে অমিল। এসব কারণে দিনি দিন যৌথ পরিবারের কাঠামোগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তাছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় পিতা-মাতার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা আর্থিক উপর্জনে অক্ষম হয়ে পড়ে। এমনকি তারা তাদের শারিরিক ও মানুষিক শক্তি হারানোর ফলে আগের মতো পরিবার নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয় না। অন্যদিকে সন্তানরা তাদের আর্থিক স্বাচ্ছলতা লাভ করে। ফলে সন্তান-সন্ততিরা আগের মতো পিতা-মাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে না। তাই তারা একধরনের পারিবারিক স্বাধীনতা গ্রহণ করতে চায়। যৌথ পরিবারগুলো ভাঙ্গার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমি মনে করি।

পরবর্তীতে মানুষ সকল আত্মীয়-স্বজন, পরিবার, পরিজন সবকিছু বাদ দিয়ে পুরোপুরি এককেন্দ্রীক অর্থাৎ একক পরিবার গড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য সবাইকে ছেড়ে শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করে কিংবা পরিবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে অন্যত্র বাসস্থান গড়ে। যৌথ পরিবার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় কারণ। তৃতীয় যে কারণ তা হলো অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে দেশ ও বিদেশে নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করতে হয়। এটিও যৌথ পরিবার ভাঙ্গার আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ গ্রামীন অর্থনীতি বিকাশের চেয়ে শহরের অর্থনৈতিক বিকাশ দ্রুত ঘটার ফলে মানুষ শহর কেন্দ্রীক হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শহর কেন্দ্রীক শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠার ফলে তারা তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে নতুন কর্মস্থলে বসবাসের সুযোগ লাভ করে। ফলে গ্রামীণ জনপদের যৌথ পরিবারগুলো আগের মতো আর যৌথ পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে রূপ লাভ করছে। 

গ্রামীণ জনপদের যৌথ পরিবার সম্পর্কে বলতে গেলে তা কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও, সবাইকে নিয়ে একসাথে আনন্দে বসবাস করা, সবকিছুতে সবার একটি অংশীদার নিশ্চিত হওয়া, সবাই মিলে সবার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া, সবার বিপদে আপদে পাশে থেকে খোজ খবর নেয়া, সবার ভালো মন্দে সবার মতামত গ্রহণ কিংবা যৌথ সিদ্ধান্তে পরিচালিত হওয়া। আর শহরের জীবন হচ্ছে কোলাহলপূর্ণ, কর্মব্যস্ততা, আর্থিক উৎকর্ষ সাধনে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখা। তবে মানুষ যখন তার প্রয়োজন কিংবা চাহিদা অনুযায়ী স্বার্থকেন্দ্রীক হয়ে নানা কারণে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে এককেন্দ্রিক হয়ে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকছে কিংবা বসবাস করছে সেখানেও ঘটছে নানা বিপত্তি আর সমস্যা। যেমন: স্বামী-স্ত্রী সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, অমিল কিংবা দীর্ঘ মেয়াদী মনোমালিন্যতার মতো ঘটনা, সন্দেহ, মিথ্যাচার। যা একক পরিবারকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে স্বামী বা স্ত্রীর অবর্তমানে অন্যকোন নারী কিংবা পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হওয়া, অর্থনৈতিক সমস্যা, দীর্ঘ মেয়াদী বেকারত্ব কিংবা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কর্মজীবি হওয়ার ফলে একক পরিবারেও তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা আর অশান্তির।

একক পরিবারে বেড়ে ওঠা স্কুল, কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। ফলে যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবার হয়ে উঠছে আরও বড় সমস্যার কারণ। ফলে ঘটছে প্রতিনিয়ত ডির্ভোসের মতো ঘটানা কিংবা পরোকিয়া। যা পারিবারিক সুখ-শান্তিকে ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট করছে। এছাড়া একক পরিবারের সন্তনরা অধিকমাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। কারণ একক পরিবারে তার ভালো মন্দ বিবেচনায় তেমন কেউ পাশে থাকে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা এরজন্য পিতা-মাতাকে দায়ী করতে পারি। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কর্মজীবি হওয়ার ফলে সন্তানদের উপর যথেষ্ট খেয়াল রাখার সময় পায় না তারা। যেহেতু একক পরিবার স্বল্প সংখ্যক মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠে তাই সন্তানদের অনেক ব্যাপারেই কোন বাধা আসেনা। ফলে যথেষ্ট তদারকীর অভাবে সন্তানরা এমন বেপরোয়া জীবন গড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

তাহলে আমরা বলতে পারি যে গত বিশ বছর আগে যেখানে পরোকিয়া কিংবা ডির্ভোসের মতো সমস্যা ছিল অতি সামান্য, সেখানে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে গিয়ে সেটা হরহামেশাই ঘটছে। যা সংখ্যায় আগের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে খোদ রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে ৩৭টি (সূত্র: প্রথম আলো, ২০২৩)। তাহলে আমরা একক পরিবারকে কিভাবে দেখছি? মূলত একক পরিবার হচ্ছে একক চিন্তা। যা কখনো কখনো নিজ স্বার্থে পরিবারের অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র প্রবলভাবে নিজের জন্য কাজ করে যাওয়া।

সুখের জন্য যেখানে মানুষ যুগের পর যুগ পরিবারের মধ্যেই সংগঠিত থাকছে। সেখানে একক পরিবার কি পারছে মানুষের সুখ-শান্তি কিংবা আশা-আকাঙ্খা গুলোকে পূরণ করতে? যদি না পেরে থাকে তবে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে আমরা কি পারছি সুখে থাকতে? যৌথ পরিবারে হয়তো কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও একক পরিবারে যে সমস্যাগুলো প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাচ্ছি, যৌথ পরিবারে হয়তো সেগুলোর মাত্রাটা কিছুটা হলেও কম পরিলক্ষিত হতো।

পূর্বে একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে আমরা দেখতে পাই সবার অংশীদারিত্বে একটা সুন্দর পরিবেশে সবাই মিলে মিশে বসবাস করত। যা একক পরিবারে কখনোই সম্ভব নয়। একক পরিবার সম্পর্কে আরেকটু যদি বলি তাহলে, একক পরিবার হচ্ছে এককেন্দ্রিক কিংবা স্বার্থকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক পরিবার। যা কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থের কথাই চিন্তা করে।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি তবে একজন মানুষ পরিবার থেকেই পূর্ণতা পায়। আরেকটু পরিস্কার করে বলতে গেলে পরিবার হচ্ছে এমন একটি সামাজিক সংগঠন যেখান থেকে মানুষের শুরু এবং শেষ। তাই পরিবারকে বাদ দিয়ে আমরা কিছু চিন্তা করতে পারিনা। এককেন্দ্রিক পরিবার বা আত্মকেন্দ্রিক পরিবারগুলোতে দিন দিন মানুষের নানা সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। যা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক গুলোকে একপ্রকার নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই আমরা বলতে পারি এককেন্দ্রিক পরিবারে অবাধ স্বাধীনতা থাকলেও মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে যৌথ পরিবারগুলোতে কোন কোন ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা না থাকলেও তা পারস্পরিক সম্পর্ক গুলোর মধ্যে সুন্দর সেতু বন্ধন রচনা করতে সক্ষম হয়।

সুখের জন্য কিংবা নিজ স্বার্থে যদি আমরা যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে আসি তবে তা সত্যিই পরিবার প্রথার জন্য মারাত্মক হুমকি বলে আমি মনে করি। একই সাথে একক পরিবারে একক স্বার্থ আর এককেন্দ্রীক চিন্তার কারণে সুখের হয় তা পুরোপুরি বলা যায় না। তাই পরিবারের অর্থ হচ্ছে এর সকল সদস্যকে নিয়ে বসবাস করা, সকলের সুখ-দুঃখকে নিয়ে চিন্তা করা। কিভাবে সবার সাথে মিলেমিশে পারস্পরিক একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। যদি এককেন্দ্রিক কিংবা স্বার্থকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাকে বাদ দেয়া যায়, তবে আমরা বলতে পারি যৌথ পরিবারও হতে পারে সুখের স্বর্গরাজ্য। তাই আসুন আমরা পরিবারের সবাইকে ভালোবাসি এবং একক চিন্তা, নিজ স্বার্থকে ত্যাগ করে সবাই সবার মাঝে সুখে থাকার চেষ্টা করি। তবে হ্যাঁ একথা সত্য এবং অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, মানুষের ব্যাক্তিগত উন্নতির জন্য যে কোন পরিবারই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Writer & Editor। Obalardak
E-mail: obalardak@gmail.com
Barishal Sadar, Barishal, Bangladesh
Mobile: +88 01516332727 (What's App)