অবেলার ডাক।। বাড়িওয়ালা নামটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। সাধারণত এই নামটির ব্যবহার হয় ভাড়াটিয়ার ভাড়া আদায়ের সময়। অনেকে বাড়ির মালিক কে পছন্দ করেন না। কারণ মাস শেষে ঠিক সময়ে তিনি বাসার দরজায় কড়া নাড়েন বলে। বিষয়টি এমন যে ভাড়াটিয়া আর বাড়ির মালিকের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্বিক যুদ্ধ লেগেই থাকে। অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যারা ভাড়াটিয়ার উপর চেপে বসেন। ঠিক সময় মতো পানির মটার ছাড়েন না, বৈদুতিক সুইচ কিংবা পানির কল নষ্ট হয়ে গেলে তা ঠিক করে দেন না অথবা দরজায় সমস্যা হলে তা সেরে দেন না, ছাদে ওঠা যাবে না, রাত ১০ টার পর বাসায় ঢোকা যাবে না। এরকম অসংখ্য নিয়ম কানুন বানিয় থাকেন ভাড়াটিয়ার জন্য। আর বাড়িওয়ালার এসব অন্যায় বিষয়গুলো ভাড়াটিয়ার মধ্যে একধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ফলে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার সম্পর্কটা গড়ায় একরকম সাপে-নেউলে অবস্থায়।
কখনো ভাড়াটিয়া হওয়ার অবস্থায় আমি বা আমার পরিবার ছিলাম না। গ্রামের সুন্দর একটি মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর অবস্থানে বাস ছিল আমাদের পরিবারের। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুন্দর একটি নদী। এই নদী দেখে দেখেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। চারদিকে কত সুন্দর পাখির কলতানি। প্রকৃতির এক মায়াবী দৃশ্য যা চোখে না দেখলে হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার বাবা খুবই সৎ একজন মানুষ। জীবনে কখনো নীতিহীন ছিলেন না। গ্রাম, মাটি আর মানুষকে ভালোবেসেছেন। কারও ক্ষতি করেছেন তিনি এমন নজির হয়তো গ্রামের কেউ দেখাতে পারবেন না। যদি কেউ পারেন তবে আমি আমার সাহিত্য জীবন ত্যাগ করবো। বাবা-মায়ের পরে যা আমি আমার হৃদয় দিয়ে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। জীবনে সৎ থাকাটা অনেক কষ্টের। লোভে পরেন না এমন মানুষ নিতান্তই নগন্য। তবে আমার বাবা ব্যতিক্রম। তিনি নীতিহীন হতে পারেন নাই বলেই আজ আমাদের এতোটা কষ্ট করতে হচ্ছে। সরকারি একটি চাকুরি দিবে বলে অনেকেই ঘুষ হিসেবে টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা তাতে রাজি হন নাই। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যাদের আপনি টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন না। আমার কাছে মনে হয় আমার বাবা তাদেরই একজন। নিজের বাবা বলে বলছিনা কথাগুলো। এরকম অসংখ্য বাবা খুজে পাবেন যারা তাদের বিবেক, মনুষ্যত্ব কে টাকার কাছে বিক্রি করেন না।
চাকরির বিষয়ে বরাবরই বাবা বলেছেন তোমার যোগ্যতা তোমাকে তোমার স্থান তৈরি করে দিবে। আমি আমার যে জমি আছে তা বিক্রি করে কিংবা টাকা ধার করে তোমার সরকারি চাকরির জন্য টাকা দিতে পারি। আমার যে সম্পত্তি রয়েছে তার মধ্যে একখন্ড জমি বিক্রি করলে তোমার চাকরির জন্য চাওয়া ঘুষের দশগুন পেয়ে যাবে। কিন্তু এরপর তুমি চেষ্টা করবে সেই ঘুষের টাকা হারাম ভাবে কামাই করতে। তারপর সারাজীবন অনৈতিক ভাবে পয়সা রোজগার করে যাবে। মনে রেখ জীবনে অনেক কষ্ট করেছি কিন্তু তোমাদের শরীরে কোন হারাম পয়সায় কেনা খবার কিনে তোমাদের খাওয়াইনি। বাবার এমন কথা শোনার পর সরকারি চাকরির কথা মাথা থেকে বের করে ফেলেছি। কারণ আমি জানি হয়তো এটা আমার জন্য না।
বাবা তার সারাজীবনের আয়ের একটি অংশ দিয়ে গ্রামের বাড়িতে নতুন বাড়ি করেন। সেখানে শখ করে বিভিন্ন মৌসুমী সবজির আবাদ করেন। যেমন: ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা, টমেটো, শিম, বরবরটি, বেগুন, কাচকলা, মরিচ। এছাড়া বিভিন্ন রকম ফলের মধ্যে সবরি কালা, নারকেল, ছোলম, শরিফা, আমলকী, গোলাপজল ছাড়াও নানা রকম ফলের গাছ লাগান। যার অধিকাংশ গাছেই ফল ধরতো। নিজেরা খাওয়ার পশাপাশি অসংখ্য মানুষকে তা বিতরণ করতাম। কখনো আত্মীয়-স্বজনকে কখনো পারা-প্রতিবেশি অথবা পরিচিতজনকে। এছাড়া মাছ চাষের জন্য ১টি পুকুর, ১টি ছোট ঘের ও ১টি ছোট ডোবা ছিল। খুব আনন্দ আর সুখের দিন কাটছিল আমাদের। কোন রাজনৈতি মতাদর্শে অন্তত আমি বা আমার বাবা কখনো ছিলাম না। আশেপাশের সবাই আমাদের অত্যন্ত ভালো জানতো। সবার সাথেই আমাদের অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু গ্রামের কিছু কতিপয় লোক আমাদের জমির উপর কু-নজর দেয়। বিভিন্ন ফন্দি ফিকির আটে। অবৈধভাবে দখল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয় প্রশাসন আর দলীয় তকমা ব্যবহার করে তারা বেশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন তারা আমাদের জমির গাছ কাটতে যায় আমাদের না জানিয়ে জোর পূর্বক। খবর পেয়ে আমার অন্যান্য চাচাতো ভাইয়েরা ঘটনাস্থলে পৌছালে তাদের সাথে মারামারি বাধে। অন্যায়ভাবে তারা ভাইদের ধরিয়ে দেয় পুলিশের হাতে। যেন সবকিছু আগে থেকেই পরিকল্পনা মাফিক সংঘটিত হচ্ছিল। যাই হোক এরপর বিষয়টি রাজনীতিকরণ করা হয়। মহরা চলে আমার বাড়ির আশেপাশে। অবস্থা এমন যে বাড়িতে আর থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না আমাদের। কারণ বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করা হচ্ছিল আমাদের। আর থাকা হলো না বাবার সারাজীবনের সৎ পরিশ্রমের টাকায় বানানো সখের বাড়িতে।
এরপর একপ্রকার বাধ্য হয়ে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে আসি বরিশালে। প্রথমে আমি বরিশালে আসি এর কয়েক মাস পর বাবা-মা কে নিয়ে আসি। বাবা-মা কে বাসা ভাড়া করে দেই। বাড়িওয়ালা কাকা দেশে থাকেন না। উনি দেশের বাইরে থাকেন। তার ছেলে জুবায়ের ভাই। খুবই আন্তরিক ও একজন দরদী মানুষ। অহংকার মুক্ত, মানব বান্ধব সত্যিকারের একজন খেদমতী মানুষ। তিনি নিয়মিত খোজ খবর রাখেন আমার বাবা-মায়ের। কোন অসুবিধায় আছে কিনা তা সবসময় খেয়াল রাখেন। সম্পর্কটা এতো ভালো যে আমি না থাকলেও জুবায়ের ভাই ও তার পরিবার আমার বাবা-মায়ের জন্য যথেষ্ট। বরিশালে পানির বিল ২০০ টাকা অধিকাংশ জায়গায়। অথচ তিনি আমাদের কাছ থেকে কোন পানির বিল নেন না। প্রতিমাসে ওয়াইফাই বিল গুণতে হোত ৭০০-৮০০ টাকা। কিন্তু তিনি আমাদের বাসার জন্য ওয়াইফাই বিল ফ্রি করে দিয়েছেন। এমনকি আমরা ৪-৫টি মোবাইলে ওয়াইফাই সংযোগ দিয়ে রাখলেও যেন কোন বাধা নেই।
যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সমস্যার সময় তিনি ও তার পরিবার আমাদের পাশে এসে দাড়ান ছায়ার মতো হয়ে। তার সাথে আমাদের রক্তের কোন বন্ধন নেই, নেই কোন পারিবারিক আত্মীয়তা, সম্পর্কটা কেবলই আত্মার আর ভালোবাসার। রমজান আসলে তার বাবা বিদেশ থেকে অনেক কিছু পাঠান। বিদেশি চকলেট, বিদেশি খেজুর আরো অনেক কিছু। এর সবকিছুর ভাগ তিনি আমাদের পর্যন্ত পৌছান। যা এখনকার সময় একজন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব ও কল্পনার বাইরে। বিষয়টি এমন না যে তিনি দিয়েছেন তাই তারা ভালো। বিষয়টি হচ্ছে আত্মার আর উদারতার। মানুষ মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার আশা করে। এটাই আমরা এখন সর্বোচ্চ প্রত্যাশা করি। কিন্তু সেটা পাওয়াও যে কত কঠিন সে বিবেচনা আপনাদের কাছেই ছেড়ে দিলাম।
গতমাসের বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য আমি ওনাকে কল করেছি। উনি প্রথমেই আমার বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তারা কেমন আছেন জানতে চাইলেন। এরপর জানালেন আগামী ৩০ তারিখে ওনার বিদেশ গমন। এরপর আমার অবেলার ডাকের বিষয়ে জানতে চাইলেন। তিনি কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন রিসালাত ভাই যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার ভোলার অনুষ্ঠানের জন্য আমি কিছু টাকা দিতে চাই। আমি খুব খুশি হলাম। ওনাকে আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানালাম। উনি আরও জানালেন আপনার লেখাগুলো পড়ি খুব ভালো লাগে। অবেলার ডাকের যে কোন আয়োজনে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। আমি আমার সাধ্যমত আপনার অবেলার ডাকের জন্য পাশে থাকার চেষ্টা করবো। এই বলে উনি ভোলার অনুষ্ঠানের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করলেন। সবচেয়ে বড় কথা ওনার ভিতরে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়েছে অবেলার ডাকের জন্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। টাকাটা বড় কথা নয়, সমাজিক ভালো কাজে যে তিনি পাশে দাড়ানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এটা খুবই চমৎকার একটি বিষয়। যা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। অনেকের টাকা থাকতে পারে কিন্তু মানুষের জন্য সমাজের জন্য করার একটি উদার মন সবার থাকে না।
আজ প্রায় দুই বছর হয় ওনাদের বাসায় আমার বাবা-মা। কিন্তু এমন হয়নি কোন মাসে যে, ওনারা আমাদের কাছে বাসা ভাড়া কিংবা বিদ্যুৎ বিল চেয়েছেন। আজ পর্যন্ত ওনারা আমাদের বাসায় বাড়ির মালিক সেজে ভাড়া তোলার জন্য কড়া নাড়েন নাই। এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি গত দুই বছরে। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে সব বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা নয়। পৃথিবীতে এমন কিছু বাড়িওয়ালা আছে যাদের সাথে আত্মার সম্পর্ক হয়।
মানুষের সত্যিকারের পরিচয় তার ব্যবহারে, তার ভদ্রতায়, তার আত্মার উদারতায়। একজন সৎ, বিবেকবান মানুষ পারেন কেবল অন্যসব মানুষের মন জয় করতে। জুবায়ের ভাই তাদের মধ্যেই একজন। প্রত্যেকটা ভালো মানুষ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা কোন না কোন ভাবে দেশ ও সমাজের উপকারে আসছেন। প্রিয় ভাইয়ের প্রতি রইলো অফুরান ভালোবাসা আর দোয়া। শুভহোক তার আগামী যাত্রা।
Risalat Mirbahar
Writer & Editor: Obalardak
E-mail: obalardak@gmail.com,
Barishal Sadar, Barishal, Bangladesh
Mobile: +8801516332727 (What's App)
Copyright Ⓒ 2025 । All Right Reserved By Obalardak [Click More]
Writer & Editor: Obalardak
E-mail: obalardak@gmail.com,
Barishal Sadar, Barishal, Bangladesh
Mobile: +8801516332727 (What's App)
Copyright Ⓒ 2025 । All Right Reserved By Obalardak [Click More]