পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী।। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের সার্বিক মুক্তির পথ যারা দেখিয়ে দেন, মহান ঐতিহ্য যারা সৃষ্টি করেন, অন্ধকার থেকে যারা মানুষকে আলোর পথে টেনে আনেন তাঁদের শিক্ষা, তাঁদের আদর্শ, তাঁদের চিন্তাধারা, তাঁদের চালচলন, তাঁদের রীতিনীতি, তাঁদের সংস্কার সব কিছুই কালে কালে, যুগ হতে যুগান্তরে, মন থেকে মনান্তরে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় ঝলমলে জ্বলন্ত দ্বীপ শিখার মতো জ্বলে। ঠিক এমনই এক জ্বলন্ত দীপশিখা, যে দ্বীপশিখা সৃষ্টির আদি থেকে নিরন্তর আলোক বিচ্ছুরিত করছে এবং অনাগত ভবিষ্যতেও করবে। যে আলোয় অন্ধকারে পথ হারানো মানুষ পাচ্ছে মুক্তির পথ। সেই জ্বলন্ত দ্বীপশিখা হলো রক্তের বন্ধু, মানবতার অন্ধকারনাশক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ, প্রতিভাবান দার্শনিক তথা মানবতার আদর্শ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন আসলে সর্বগুণে গুণান্বিত অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহামানব, যার মধ্যে নিখিল বিশ্ব ও এর নান্দনিক সৃষ্টি প্রতিবিম্বিত হয়েছে। তিনি শুধু মানুষের জন্যই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ছিলেন তা নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টির জন্যই তিনি ছিলেন চিরন্তন অনুপম আদর্শ। এ কারণেই আমাদের এই মাটির পৃথিবী থেকে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত সর্বত্র ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। এজন্য কোন মানুষের সাথে তুচ্ছ অর্থে তাঁকে তুলনা করা যায় না। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজেই বলেছেন, "লাসতো কা আহাদিকুম ইন্নী আবিতো ইনদা রাব্বি ইউৎমিনি অ ইউসকিনি"। অর্থাৎ "আমি তোমাদের কাহারও মতো নই, আমি আমার প্রভুর সান্নিধ্যে রাত্রি যাপন করি, তিনি আমাকে পানাহার করান"। এটাই যখন হযরতের সত্য রূপ, তাহলে তাঁকে সাধারন মানুষ ভাবার প্রশ্নই উঠে না। আবার তাঁকে প্রচলিত অর্থে অন্যান্য মহামানবের সাথে তুলনা করাও সঙ্গত নয়। কারণ অন্যান্য মহামানবের মধ্যে বিরাজমান বাস্তবতার কারণে বিভিন্ন অসম্পূর্ণতা, দুর্বলতা থাকতেই পারে। কিন্তু নবী মুহাম্মদের মধ্যে সেরকম কোন দুর্বলতা ছিল না। এজন্য বলা হয়, নবী মুহাম্মাদ (সঃ) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক, যার বিপ্লবী সংস্কারে একটি অধঃপতিত জাতি উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেছিল। সংস্কারক হিসেবে তিনি সার্থক কালজয়ী বলেই বর্তমান সংঘাতমুখর বিশ্বে প্রতি পদক্ষেপে তাঁর প্রয়োজন অনভূত হচ্ছে। হয়তো তাই বার্ণাড'শ এর মতো বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বলেছেন, "আজ যদি মুহাম্মদ দুনিয়ার ডিক্টেটর হতেন, তাহলে জগতে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করতো। "তিনি আরও বলেন, "বিশ্ববাসী, যদি তোমরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে চাও এবং সর্বাঙ্গীন সুন্দর জীবন ব্যবস্থা কামনা কর, তবে সংসারের নিয়ন্ত্রণ ভার মুহাম্মদের হাতে ছেড়ে দাও যুগে যুগে পৃথিবীতে অনেক সংস্কারক এসেছেন। অনেক সংস্কারও তারা করেছেন। কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সংস্কারের তুলনায় তাদের সংস্কার নিতান্ত ম্লান। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন শুধুমাত্র আরব দেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বেরই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থা এক চরম সংকটের মুখোমুখি, নাজুক অবস্থায় নিপতিত ছিল। এই ক্রান্তিকালে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বৈপ্লবিক সংস্কারের মাধ্যমে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পাপাসক্ত ও পশুত্বের পর্যায়ে উপনীত মানব গোষ্ঠীকে ভয়াবহ অবস্থা হতে উদ্ধার করে নতুন এক আলোকিত জীবনের সন্ধান দেন।
মানব সমাজকে তিনি শুধু মুখের বাণী দিয়েই আশ্বস্ত করেন নি, নিজে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেও দেখিয়েছেন। মানব সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন ছিলো, তার সবকিছুই তিনি প্রথমে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেই তারপর অন্যকে তা পালন করার কাজে উদ্ভুদ্ধ ও উৎসাহী করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হেরাগুহায় ধ্যান, তাবলিগ, গৃহস্থালি, ব্যবসা, যুদ্ধ, রাজ্য গঠন, রাজ্যশাসন ইত্যাদি সবকিছুই করেন। রাখালের দায়িত্ব হতে রাজ্যশাসন-রাজত্ব পর্যন্ত সকল অবস্থার মধ্য দিয়েই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। গৌতম বুদ্ধ, শ্রী চৈতন্য প্রভৃতি সংস্কারকের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখি, তারা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সংসার বিরাগী। তাঁদের জীবনধারায় মানব জীবনের সর্বস্তরের উদাহরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও প্রচারিত ধর্মমতে যুগ জিজ্ঞেসার সর্ব বিষয়ে নির্ভরযোগ্য জবাব পাওয়া যায়। তাছাড়া জীবনকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করার জন্য যা প্রয়োজন তার সবকিছু অন্যরা নবী মুহাম্মদের মতো বাস্তব জীবনে দেখিয়ে যেতে পারেন নি।
মার্ক্স, লেনিন, মাও সেতুং এদেরকে আমরা আধুনিক সংস্কারক হিসেবে গণ্য করে থাকি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এদের সংস্কারও হযরতের সংস্কারের তুলনায় অসম্পূর্ণ, নিস্প্রভ। এরা কার্যতঃ বিভিন্ন মতবাদের প্রবক্তা হলেও এসবের কার্যকারিতা ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী নয়। এক সময়ে এসব মতবাদ কিছুটা আলোড়ন তুললেও একবিংশ শতকের সূচনালগ্নে এসে এসবের অসারতা দিন দিন দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। হযরতের জন্মক্ষণে আরব তথা সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয় অবস্থা ছিল অত্যন্ত জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক। তখন মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির পায়ে মাথা নোয়াতো। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল অপরিমেয়। নিম্নবিত্তের ও শারীরিকভাবে দুর্বলরা ছিল দাসানুদাস। তখনো নারীর কোন মর্যাদা ছিল না, তারা ছিল পুরুষের ভোগ্যপণ্য অথবা সেবাদাসী মাত্র। পরিবারের কর্তা ইচ্ছে করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করতে পারতো। পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোন অংশ ছিল না। সামাজিক সুবিচার ও সুশৃঙ্খল নিরাপদ জীবন যাপন ছিল সুদূর পরাহত। গোত্র কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুণ্ঠন, হানাহানি, ব্যভিচার, জুয়া, সুদপ্রথা, মদ্যপায়ীদের তান্ডবে জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিসহ। এই অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সম্বলিত একটি নতুন আলোকিত ধর্ম প্রচার করেন, যা মানুষকে সার্বিক মুক্তির পথ দেখিয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কখনও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা পছন্দ করতেন না। তিনি গায়ে পড়ে কারও সাথে যুদ্ধ বা ঝগড়া করেন নি। তার প্রতিটি যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক। তিনি তাঁর অনুসারীদের পৃথিবীর সব ধর্মনেতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, অথচ অন্য ধর্ম প্রচারকদের এ ব্যাপারে নিরবতা লক্ষণীয়। তাঁর বিখ্যাত 'মদীনার সনদ' এর ৪৭টি শর্তের অন্যতম শর্ত ছিল, ‘মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’ এ থেকেই বুঝে নেয়া যায়, তিনি কতটা সাম্প্রদায়িক চেতনার ছিলেন।
রাজনৈতিক দিক দিয়েও বিশ্বনবী শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সেই অনগ্রসারতার যুগে তিনি যে রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করে গেছেন তা আজও বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের অনুপ্রেরণার উৎস, পথ চলার নির্দেশিকা। তাঁর রাজ্যে মানুষ শান্তি-শৃঙ্খলার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতো। প্রাক-ইসলামী যুগে রাজনীতি ছিল জাতি বা গোষ্ঠীভিত্তিক, যাতে নাগরিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনোই মূল্য ছিল না। বিশ্বনবী এরূপ পক্ষপাত দুষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে জনসমর্থনপুষ্ট পরামর্শভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। শাসনকার্যের সুবিধার্থে তিনি তাঁর দেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা আল ওয়ালী ও বিচারক নিযুক্ত করেন। তিনি জীবনে ২৭৬টি রাজ্যকে একত্রিত করে নয়লক্ষ বর্গমাইল এলাকায় এক বিশাল রাষ্ট্র কায়েম ও পরিচালনা করেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিভিত্তিক সাম্য ও ন্যায়কেন্দ্রিক কল্যাণমূলক আদর্শ ছিল তাঁর শাসনের মূলকথা। তাঁর প্রবর্তিত 'মদীনা সনদ' সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত ও বিধিবদ্ধ সংবিধান। তিনি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্যার টমাস আর্ণল্ড বলেন, "ইসলাম একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি, যার প্রভাব পৃথিবী প্রান্ত যতই নিকট থেকে নিকটতর হবে, ততই অধিক থেকে অধিকতর অনুভব করবে পৃথিবী। পৃথিবীর সব অমঙ্গলের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ইসলাম। আমার দিক থেকে তা নিরর্থক অতিশয়োক্তি নয়। পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় যা হচ্ছে তার চিন্তাশীল প্রত্যেক পর্যবেক্ষক এই সত্যি অনুধাবন করতে পারবেন। কারণ ইসলামেই শুধুমাত্র জাতিসংঘের প্রকৃত বিষয়বস্তুর ধারণাকে যথার্থ ও বাস্তবসম্মত উপায়ে মোকাবিলা করা হয়েছে। "মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ভাষায়, "ইসলাম হচ্ছে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার একটা পূর্ণাঙ্গ বিধান। ইসলাম এসেছে দুনিয়ার মানুষেরা হাতে আজাদী ফিরিয়ে দিতে। যে আজাদী শাহী তখত, সম্রাজ্যবাদী শক্তি, স্বার্থান্ধ ধর্মনেতা ও সমাজের উপর তলার মানুষ লুঠে নিয়েছিল। তারা বুঝেছিল, শক্তিই সত্যি- জোর যার মুল্লুক তার। ইসলাম এসে ঘোষণা করলো- শক্তি সত্যি নয়, সত্যই সত্যি। খোদার বান্দাকে দাস বানাবার অধিকার নেই আর কারও।
গোত্র, জাতি ও শ্রেণীভেদ চিরতরে ধূলিসাৎ করে ইসলাম জানিয়ে দিল, মানুষ মানুষেরই ভাই, সবারই সমান অধিকার। মানদন্ড বংশ, জাতি বা বর্ণ নয়। যার কাজ ভালো তার সব ভালো। মানবাধিকারের এ সনদটি ফরাসি বিপ্লবের এগার'শ বছর আগেই ইসলাম দুনিয়াকে দিয়ে গেছে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে বলতে হয়, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সর্বপ্রথম অর্থ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারনার পরিবর্তনে এগিয়ে এলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন-মানুষ ধন-সম্পদ বা অর্থের দাস নয়, ধন-সম্পদ মানুষ অর্জন করে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু এ বেঁচে থাকা ধন-সম্পদের জন্য নয়। বরং স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য। সুতরাং স্রষ্টা অসন্তুষ্ট হয় এমন উপায়ে ধন-সম্পদ অর্জন করা হারাম। এভাবেই তিনি মানুষের উপর মানুষের শোষণের পথ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী উপবাস থাকে, সে আমার দলের নয়। ‘তিনি মজুতদারদের হুশিয়ার করে বলেছেন, ‘মূল্য বর্ধিত করার মানসে যদি কেহ তার পণ্যদ্রব্য ৪০ দিন গুদামজাত করে রাখে, তবে তার খোদার সাথে তার এবং তার সঙ্গে খোদার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। "সক্ষম মানুষকে তিনি কাজ করে খেতে বলেছেন।
ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক ইনসাফপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থার প্রবর্তন, মুনাফায় শ্রমিকদের অধিকার, উপার্জনহীন লোকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, যাকাত প্রথার প্রচলন ইত্যাদি বিশ্বনবীর অর্থনৈতিক সংস্কার নয় কি? এসব কি মানুষকে সামান্য মাত্রায়ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না? আজ যদি আমরা হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আদর্শ পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলি, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবেই। তখন মানুষে মানুষে থাকবে না বৈষম্য, স্বার্থের সংঘাত, ধনী-গরিব তফাৎ, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব, উঁচু-নীচু গোত্র বা জাতীভেদ, অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে, যুদ্ধ বন্দীর উপর চলবে না নিমর্মতা। বস্তুত জেনেভা কনভেনশনের অনেক আগেই হযরত যুদ্ধবন্দী হত্যার প্রচলিত রীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। যৌতুক প্রথা রহিত করেছিলেন। তিনি নারীকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। পরিবারের সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি গ্রীক, রোমান, ইহুদি, খ্রীষ্টান ও আরবদের মাঝে প্রচলিত দাসপ্রথা উচ্ছেদ করে দাসদের মর্যাদাবান করেছেন। ক্রীতদাস বেলালকে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ও ক্রীতদাস যায়েদকে সেনাপতি বানিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন ইসলামে ‘মুনিব-দাস’ বলে কিছু নেই। আর কোন সংস্কারক কি ইতোপূর্বে এমন উদারতা দেখাতে পেরেছেন?হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারক। ঐতিহাসিক টমাস কার্লাইল ও উইলিয়াম এম. ওয়াট তাঁকে ইতিহাসের প্রভাবশালী সংস্কারক এবং মাইকেল এইচ. হার্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশ মনীষী বইয়ে তাঁকে প্রথম স্থানে রেখেছেন।
বিবাদমান আরব জনগোষ্ঠীকে একীভূতকরণ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠকীর্তি। পারিবারিক কাঠামো সুদৃঢ়করণ, দাসপ্রথা রহিতকরন, নারী ও শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন, মূল্যবোধে নৈতিকতার অবস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর সংস্কার ছিল বিপ্লবের মতো। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে অনেকভাবেই নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র এ আলোচনায় তা সম্ভব নয়। কারণটা মিঃ আর. ভি. সি ব্যাডলে এর ভাষাতেই বলি, "মূসা, কনফুসিয়াস অথবা বুদ্ধের সমসাময়িক রেকর্ডাদি যেখানে আমরা পাই না, যীশুর জীবন সম্পর্কে যেখানে আমরা অংশেরও অংশ মাত্র জানি, সেখানে নবী মুহাম্মাদের কাহিনী চরমভাবে পরিস্কার। এখানে অস্পষ্টতা ও রহস্যময়তার পরিবর্তে পাই ইতিহাস। মুহাম্মদ সম্পর্কে আমরা ততটুকু জানি, যতটুকু জানি আমাদের কালের খুুব নিকটে বেঁচে থাকা মানুষদের সম্পর্কে।" তাই আলোচনার পরিধি না বাড়িয়ে পরিশেষে শুধুমাত্র একথাই শুধু বলতে চাই, নিঃসন্দেহে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। বর্তমান সংঘাতমুখর দুনিয়ায় একমাত্র তিনিই দিতে পারেন আলোকিত পৃথিবীর সন্ধান।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
খুলশী, পূর্ব নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।